নারায়নগঞ্জের সাংষ্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব জনাব রফিউর রাব্বি সাহেবের বিরুদ্ধে ঐ একই জেলার হেফাজত ইসলামের সমন্বয়ক ফেরদাউসুর রহমান ধর্ম অনুভূতিতে আঘাত দেবার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। এই মামলার পেছনে যে নারায়নগঞ্জের গডফাদার ফলে পরিচিত শামীম ওসমানের হাত রয়েছে এবং তার প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে সেটিও খুব সম্ভবত সবাই এরইমধ্যে জেনে গেছেন। আমি ধরে নিচ্ছি ফেরদাউসুর এই মামলা করেছেন বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৯৫(ক) ধারা অনুসরণ করে।
প্রশ্ন আসতে পারে যে জনাব রাফিউর রাব্বি কি এমন কথা বলেছেন যেটিতে হেফাজতের ফেরদাউসের ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে?
ঘটনা হচ্ছে গত ৭ এপ্রিল ২০১৭ ইং তারিখে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমীর ২৫ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে রফিউর রাব্বি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘যদি বাংলার মানুষ জানতো সংবিধান বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দিয়ে শুরু হবে, দেশ হবে সাম্প্রদায়িকতার দেশ, তবে ত্রিশ লাখ শহীদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতো না।’
আমি একজন মুসলমান হলেও, এই বক্তব্যে আমার সামান্যতম ধর্মের অনুভূতিতে সমস্যা তৈরী হয়নি বরং আমি মনে করি জনাব রাফিউর রাব্বি অত্যন্ত সঠিক ও যথার্থ কথাটাই বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ যেসব মূল ভিত্তি, স্পিরিটের উপর ভর করে সামনে এগিয়েছে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র যেসব চিন্তার ফলশ্রুতিতে গঠিত হয়েছে সেখানে সংবিধান বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু হবে, চিন্তাই করা যায় না।
সংবিধানে বিসমিল্লাহ বাক্যটি নিয়ে বাংলাদেশে গত ৪ দশক ধরে অসংখ্য ব্যাক্তি বিরুদ্ধ মত দিয়েছেন এবং তাঁদের মতের পক্ষে অনেক যুক্তি দিয়েছেন। সংবিধানের মাথায় ধর্মীয় লেবাস কিংবা টুপি পরাবার জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাধীন হয়নি।ধর্ম নিরপেক্ষ এক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নেই বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গেছে। এই স্পিরিটের কথা ৭০ এর নির্বাচনের বহু আগ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর অসংখ্যা বক্তৃতা বিবৃতিতে রয়েছে। এসব নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে অতীতে। নতুন করে ঐ একই কথা কেন হেফাজতের ধর্ম অনুভূতিতে আঘাত দেয়, সেটা পাব্লিক বোঝে। রাফিউর রাব্বিকে একটু টাইট দিতে হবে শামীমের, তার ক্রোধের জ্বালা মেটাতে হবে। এই হচ্ছে ঘটনার পেছনের ঘটনা।
অবৈধ সামরিক শাষক জিয়াউর রহমান বিসমিল্লাহ সংক্রান্ত পূর্বতন অধ্যাদেষ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে ১৯৭৯ সালের ৬-ই এপ্রিল যোগ করে।
শামীম ওসমান হয়ত জানেন না যে ১৯৭৯ সালেই এই সংবিধানের অধ্যাদেষের বিরুদ্ধে সে সময়কার রাজনীতিবিদেরা বলে গেছেন অত্যন্ত তীব্র ভাষায়। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী এই সংশোধনীকে স্বাধীনতার সফলতাকে বাঞ্চাল করার চক্রান্ত বলে অভিহিত করেন। ইনফ্যাক্ট রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করবার ফলে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ডাকেই হরতাল পালিত হয়েছিলো ১৯৮৮ সালে। সে সময় রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীরা রাস্তায় গাড়ি ভাংচুরও করেন।
আজকে শামীম নিজের রাজনৈতিক ক্ষোভ, চিন্তা এগুলোকে একোমোডেট করবার জন্য জিয়ার সংশোধনীকেও সমর্থন দিচ্ছে নির্লজ্জের মত। অবশ্য শামীমের কাছে এর থেকে বেশী কিছু আশা করাটাও বোকামী।গত কয়েক যুগ ধরে শামীম ও শামীর পরিবার যেভাবে নারায়নগঞ্জকে টেরোরাইজড করে রেখেছে সেগুলোর বৃত্তান্ত পত্র-পত্রিকাগুলো ঘাটলেই জানা যায়।
জনাব রাফিউর রাব্বির মামলায় সহায়তা করার জন্য আমি আমার এই লেখার সাথে কিছু ডকুমেন্ট যোগ করেছি। এগুলো ৯ম জাতীয় সংসদের ৯ম অধিবেশনের ২৭ তম বৈঠকের সংসদীয় নানাবিধ যুক্তি, তর্ক, প্রস্তাব তথা সংসদের কার্যাবলীর বিবরণ। যেখানে সমগ্র জাতির সামনেই সরাসরি সংবিধানে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম বাক্যটি নিয়ে মাননীয় সাংসদেরা তাঁদের বিরুদ্ধ মত তীব্র ভাবেই জানিয়েছিলেন এবং জনাব রাফিউর রাব্বির আজকের বক্তব্যই বহু আগেই সঙ্গসদে আলোচিত হয়েছে। এই সংসদীয় প্রসেডিংস তিনি তাঁর মামলা চলাকালীন সময়ে আদালতে সাবমিট করতে পারেন।
যে সংশোধনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে গেছেন সেই ১৯৭৯ সালেই, যে বিসমিল্লাহ সংযুক্ত করবার বিরুদ্ধে মহান সংসদে সাংসদরা জাতির সামনে কথা বলেছেন সেই একই কথা রাফিউর রাব্বি বললে সেটি হয়ে যায় ধর্ম অবমাননা? শামীম ওসমানের চ্যালারা তখন কই ছিলো?
রাফিউর রাব্বির সাথে শামীম ওসমানের পরিবারের সমস্যা রয়েছে। রাফিউর রাব্বির বাচ্চা ছেলে ত্বকীকে শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী তার টর্চার চেম্বারে নিয়ে খুন করেছে বলে আমরা পত্রিকার মাধ্যমেই জেনেছি। তার উপর শামীমের পলিটিকাল রাইভাল মাননীয় মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী’র সাথে রাফিউর রাব্বির সখ্যতা রয়েছে। নির্বাচনে রাব্বি সাহেব সেলিনা হায়াত আইভীর পক্ষে কাজ করেছেন এবং একই সাথে ত্বকী হত্যাকান্ড শামীমের পলিটিকাল ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলেছে। সুতরাং ধর্ম অনুভূতি নিয়ে মামলা কিভাবে এখন হচ্ছে, কেন হচ্ছে সবই পাবলিক বোঝে।
টুপি পরে শামীম এখন মসজিদে যে গরম বক্তৃতা দিচ্ছে সেগুলো যে নিতান্তই তার পলিটিকাল স্টান্টবাজি সেটি বুঝতে খুব বেশী বুদ্ধিমান হবার দরকার নেই। ধর্মকে সূত্র ধরে কি নোংরা খেলা হতে পারে তার একটা বড় উদাহরন হচ্ছে রাফিউর রাব্বির বিরুদ্ধে ধর্মনুভূতিতে আঘাত দেবার মামলা। ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মত বরাবরের মত হেফাজতের অশিক্ষিত মোল্লাগুলোও কন্ডমের মত ব্যবহৃত হচ্ছে।
যাই হোক, এই ডকুমেন্ট গুলো দেয়াই ছিলো উদ্দেশ্য। যদি তাতে কোনো লাভ হয়।