আজ অনেকদিন পর লিখতে বসলাম। আজকাল লেখালেখিটায় কেমন যেন আলসেমির ধুলো পড়েছে তাই আর লেখালেখি হয়ে উঠে না। জীবনটা অবসাদে পরিপূর্ণ । চিকিৎসকের কাছে যাতায়াত গত ১ বছর যাবত । অবসাদ কাটেনি কিন্তু ঘুমটা বেড়েছে । আজ কিছুদিন হল লেখালেখি করার জন্য মনটা কেমন যেন করছে তাই লিখতে বসলাম। গতকিছুদিন যাবত সমাজ এবং সামাজিক অবক্ষয় গুলো মনকে বেশ নাড়া দিচ্ছে। তাই আজকে এই লেখাটা লিখছি।
সবার আগে আমি পরিবার এবং সমাজের সেই সংজ্ঞাটা মনে করিয়ে নিই যেটা আমরা ছোট থাকতে স্কুলের বইতে পড়েছিলাম। মা, বাবা, ভাইবোন মিলে হয় পরিবার। আর কতগুলো পরিবার নিয়ে গঠিত হয় সমাজ। আজ যে সমাজের কথা বলতে যাচ্ছি সেখানে পরিবারও আছে, আছে আত্মীয় স্বজন সবকিছুই শুধু নেই সামাজিক মূল্যবোধ। নেই কোন সামাজিক সচেতনতা। আজ যখন সমাজের দিকে তাকাই তখন দেখি কিভাবে চারদিকে খুন ধর্ষণ, ঠগ বাজি, মারামারি, স্বার্থপরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমার জন্ম আশির দশকে বেড়ে উঠা নব্বইর দশকে। নব্বইর দশকেই ডিজিটাল যুগের শুরু। স্যাটেলাইট চ্যানেল গুলো সবে মাত্র ডানা মেলতে শুরু করেছে। তখন থেকেই সামাজিক অবক্ষয় বিস্তার লাভ শুরু করে। সামাজিক আবক্ষয়ের জন্য অনেকগুলো বিষয় দায়ী। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচারহিনতা, দায়িত্বহীন এবং স্বার্থপরতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, নাট্য শিল্প ও নাট্য কর্মী, মানবিক শিক্ষার অভাব, একান্নবর্তী পরিবারের বদলে ছোট বিচ্ছিন্ন একক পরিবার গঠনে আগ্রহী, আত্মিক সুখের চাইতে ইন্দ্রিয় সুখের প্রাধান্য, বৈবাহিক বন্ধনে অনীহা, পর্ণের প্রতি আসক্তি এবং ডিজিটাল মিডিয়ার অপব্যবহার।
রাজনৈতিকঃ একটি সমাজের বা দেশের সার্বিক উন্নয়নের পিছনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক বড় ভুমিকা রাখে। ঠিক বিপরিতে একটি সমাজের অবক্ষয়ের পেছনেও রাজনৈতিক পরিস্থিতিই দায়ী। ক্ষমতা লোভী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিভিন্ন নাশকতা মুলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়।
অর্থনৈতিকঃ আজকাল অর্থের সাথে নৈতিকতার অভাব বেশ পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে বলার আগে আমি একটু নব্বইর দশক থেকে ঘুরে আসি। ঐ সময়ে বাবা মায়েরা যতই অর্থনৈতিক দিয়ে সাবলম্বি হোক না কেন ছেলে মেয়েদেরকে অর্থ বা টাকা একটা সীমিত পরিমানে দিতেন। আমরা যখন ছোট ছিলাম ২ টাকার জন্য কি কান্নাটাই না করতে হত। আমরা একটা বল কেনার জন্য ২ টাকা করে চাঁদা দিয়ে কয়েকজন মিলে একটা বল কিনতাম। তারপর সেই বল দিয়ে পরম মমতায় খেলা করতাম। আর এখন একটি ছোট বাচ্চার হাতে দামি আই ফোন দেখাটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এখন আপনি অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বি বলে আপনার বাচ্চাকে আই ফোন কিনে দিচ্ছেন। কখন ভেবে দেখেছেন আপনার বাচ্চাকে কতটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। কারন আজ যে বাবা মা তার সন্তানকে আই ফোন কিনে দিতে পারছে না সেই বাবা মার সন্তান আপনার বাচ্চার জন্য হুমকি তো হয়ে উঠবে না।
বিচারহিনতাঃ বিচারহিনতা একটি সমাজকে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট । প্রশাসনিক কর্মকর্তা যখন দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে ফলে খুন ধর্ষণের মত অপরাধ বেড়েই চলে।
দায়িত্বহীন ও স্বার্থপরতাঃ প্রবাদে আছে ” ভদ্রতা যখন বিবস্ত্র হয় তখন ভদ্রলোকেরাই বেশি আনন্দিত হয়।” ধরুন একটি মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে । ভদ্রলোকেরা মেয়েটিকে সহানুভুতি না দেখিয়ে তাকে নিয়ে আরও সমালোচনায় লিপ্ত হয়। নিশ্চয়ই মেয়েটির চাল চলন ভাল ছিল না। বা একটি মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে দেখে তাকে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে এই ভেবে যে আমার মেয়ে তো না। এটা তো মাত্র একটি উদাহরন এরকম আরো অনেক উদাহরন আছে। এভাবে দায়িত্বহীন ও স্বার্থপরতা সমাজকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে একবার ভেবে দেখেছেন কি?
ধর্মীয় বিদ্বেষঃ বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় হতে ধর্মীও বিদ্বেষ এর যে প্রসারন ঘটেছে তাতে কি সমাজের খুব বেশি লাভ হয়েছে নাকি শুধুই ক্ষতি হয়েছে? হ্যাঁ কিছু ধর্ম ব্যবসায়ীর লাভ হয়েছে সমাজের মানুষের নয়। এখন সারা বিশ্ব জুরে যে যুদ্ধ চলছে তা কেবল ধর্ম নিয়েই। এটা শুধু সন্ত্রাসবাদের জন্মই দিচ্ছে না পুরো মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাট্য শিল্প ও নাট্য কর্মীঃ বলা হয়ে থাকে নাটক নাকি সমাজের প্রতিফলন ঘটায় । কথাটা অনেকাংশেই সঠিক । নব্বইর দশকে আমরা যখন ছোট ছিলা্ম তখন একটি টি ভি সিরিয়াল খুব জনপ্রিয় ছিল । “ম্যাগায়ভার“। ঐ টি ভি সিরিয়াল দেখে আমরা এতোটাই রোমাঞ্চিত হতাম যে সব সময় ম্যাগায়ভার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। তাহলে ভেবে দেখেন নাটক বা চলচিত্র জীবনের উপর কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে। তাই নাটক বা চলচিত্রে অপরাধ মুলক বিষয় গুলো ভেবে চিন্তে দৃশ্যায়ন করা উচিত। যারা নাট্য কর্মী আছেন তাদেরও কথাবার্তায় সংযমী হওয়া উচিৎ। সালমান খান বা পূর্ণিমার মত বড় তারকারা যখন ধর্ষণের মত ব্যাপার নিয়ে হাস্য রস করে তখন হতাশ না হয়ে পারিনা।
মানবিক শিক্ষার অভাবঃ আজকাল মানবিক শিক্ষার খুব বেশি অভাব। মানবিক শিক্ষার চেয়ে পরীক্ষায় পাশের শিক্ষাকে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। মানবিক শিক্ষার শুরু হয় পরিবার থেকে। অথচ আজকাল পরিবার গুলো এই শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। ছোট একটি উদাহরন দেই আজকাল বাবা মায়েরা তার সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সময় কিছু খাবার দিয়ে দেয় যাতে তার সন্তানটি বিরতির সময় কিছু খেয়ে নেয়। এটা নিশ্চয়ই খুব ভাল একটা ব্যাপার কিন্তু সন্তানটিকে পরিবার থেকেই বলে দেয়া হয় সে যেন তার খাবারটি সহপাঠীদের সাথে শেয়ার না করে। এখন ভেবে দেখেন আপনার সন্তানটিকে আপনি স্বার্থপর বানাচ্ছেন না তো?
একান্নবর্তী পরিবারের বদলে ছোট বিচ্ছিন্ন একক পরিবার গঠনে আগ্রহীঃ বর্তমান সময়ে ছোট একক পরিবারের জনপ্রিয়তা বেশ। একান্নবর্তী পরিবার খুব একটা চোখে পড়ে না। একক পরিবারের বাবা মা দুজনেই কর্মে ব্যস্ত থাকেন ফলে সন্তানকে সেভাবে দেখাশোনা করতে পারেন না। যে কারন সন্তান হতাশায় ভোগে। যে কারনে সন্তানটি বিভিন্ন অপরাধ্মুলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে বা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে ।
আত্মিক সুখের চাইতে ইন্দ্রিয় সুখের প্রাধান্যঃ ইদানিং ইন্দ্রিয় সুখকেই আত্মিক সুখ মনে করা হয়ে থাকে। নব্বইর দশক বা তার আগে প্রেম ছিল আত্মিক সুখ। আর এখন বেশির ভাগ প্রেম মানেই যৌন বাসনা। যেটা কিনা ইন্দ্রিও সুখ। আজকাল এই ইন্দ্রিও সুখ কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেকেই অপরাধের সাথে জড়িয়ে পরছে। বেশ কিছু ঘটনা আমাদের সামনে আসছে । তার মধ্যে একটি ঘটনা খুবই হৃদয় বিদারক। এক ছেলে তার মায়ের পরকীয়া দেখে ফেলায় ছেলেকে খুন হতে হয়েছে মায়ের হাতে।
বৈবাহিক বন্ধনে অনিহাঃ বর্তমান ছেলে মেয়েদের মধ্যে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ খুব কম। শুধু যৌনতাকেই প্রাধান্য দেয় বর্তমান ছেলে মেয়েরা।
মাদকের বিস্তারলাভঃ মাদক সমাজের প্রতিটা স্তরে যেভাবে বিস্তারলাভ করেছে তা দেখে সত্যি খুব ভয় হয়। ঐশীর ঘটনাটাকে আদর্শ হিসেবে যদি ধরি তাহলেই বোঝা যায় সামাজিক অবক্ষয় কতটা হয়েছে।
পর্ণের প্রতি আসক্তি ঃ পর্ণের প্রতি আসক্তি ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে। আজকাল ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও পর্ণের প্রতি আসক্ত। পর্ণ সাইট গুলো সহজ লভ্য হওয়ায় ছোট ছেলে মেয়েরাও পর্ণ দেখে। ফলে অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা কৌমার্য হারাচ্ছে।
মানসিক বিকৃতি ঃ মানুষের দিন দিন মানুষিক বিকৃতি দেখা দিচ্ছে। যার ফলে অনেক অপরাধ মুলক ঘটনা ঘটছে । নবজাত শিশুও এই বিকৃত মানসিকতার মানুষের যৌন লালসার শিকার হচ্ছে ।
ডিজিটাল মিডিয়ার অপব্যবহার ঃ ডিনামাইট তৈরি করা হয়েছিল মুলত খনিজ সন্ধানের জন্য কিন্তু পরবর্তীতে তা ব্যবহার করা হোয় যুদ্ধ ক্ষেত্রে । ঠিক ডিজিটাল মিডিয়াও সৃষ্টি হয়েছিলো মানুষের যোগাযোগের জন্য । কিন্তু কিছু মানুষ আজকাল ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে সমাজে কলহ সৃষ্টির জন্য।
সব শেষে আমি এটাই বলতে চাই আমরা আজকে সমাজকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা কি আদৌ আধুনিক হতে পেড়েছি নাকি সেই আদিমকালের গুহা মানবই রয়ে গেলাম?