ক্রাইস্টচার্চে জঙ্গি হামলার বিষয়ে কিছু কথা বলা খুব দরকার, যা শুনলে মনে হবে আমি হামলার ভুক্তভোগীদের এই হামলার জন্য দায়ী করছি। কিন্তু না, একটা আদর্শ দিয়ে অনুপ্রাণিত একজন জঙ্গি এই হামলার জন্য দায়ী, আর দায়ী সে আদর্শ। ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেওয়া ভাল। যাঁরা মারা গেছেন তাঁরা নির্দোষ, দোষী খুনী আর আর আদর্শিক মতবাদ৷
সোশিওলজিতে তথা সোশিওলিঙ্গুইস্টিকসে (সামাজিক-ভাষাবিদ্যা?) একটা ব্যাপার আছে যেটা কাজ করে একজন বা একদল লোকের অন্য একটা ঐতিহ্য-সংস্কৃতির দেশের লোকের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার (বা না নেয়ার) সাথে দ্বিতীয় ভাষা শেখার সম্পর্ক নিয়ে৷ (অভিবাসীর নিজের মাতৃভাষা তাঁর ১ম ভাষা, অভিবাসিত দেশের ভাষা হচ্ছে তাঁর লক্ষ্য-ভাষা বা ২য় ভাষা৷) এই ব্যাপারটাকে বলে cultural assimilation বা সাংস্কৃতিক আত্মীকরণ৷
সাংস্কৃতিক আত্মীকরণের প্রথম ধাপ হচ্ছে লক্ষ্য-সংস্কৃতির (target culture) লোকের প্রতি উদারতা (openness)। আমাদের বাঙালীদের যেটা হয় সেটা হচ্ছে বিদেশ গিয়ে প্রথমেই খুঁজে নেব দেশী ভাইবোন কে আছেন আশেপাশে! (Ironically, দেশের অধিকাংশ মানুষই অন্য বাঙালীকে বিশ্বাস করতে চায় না)। তাঁদের খুঁজে নিয়ে তাদের আশেপাশে থাকা, একটা কম্যুনিটি বানিয়ে ফেলা অবশ্য নতুন অভিবাসীদের সাহস যোগায়। কিন্তু দিন শেষে আপনার সে দেশের সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবেই। আর তাই আপনার উচিত সে দেশের লোকেদের সাথে মেশার চেষ্টা করা।
তবে এটা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। গবেষণায় দেখা গেছে পরিবারভেদে ১ম প্রজন্মের চেয়ে ২য় প্রজন্ম সাংস্কৃতিক আত্মীকরণে বেশি সক্ষম হয়৷ পরিবারভেদে, কারণ অনেক পরিবারই তাঁদের সন্তানকে “অপসংস্কৃতির” লোকের সাথে মিশতে দিতে চান না। উল্টোটা হলে আমরা খুব তালি বাজাই৷ আমরাই খুশিতে গদগদ হয়ে যাই যখন বিদেশের একটা বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার নাম বাংলায় দেওয়া হয়৷ কিন্তু এই আমরাই ক্ষোভে ফেটে পড়বো যদি রোহিঙ্গারা ভাষানচরে গিয়ে ভাষানচরের নাম নিজেদের ভাষায় করতে চায়।
নিজের দেশের লোক যেখানে কম সেখানে পরবর্তী যে জিনিসটা কম্যুনিটি বানানোর ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে ওঠে সেটা হচ্ছে নিজের ধর্মের অন্য দেশের লোক। এখানে ঐতিহ্যগত পার্থক্য থাকলেও মানুষ এক সাথে মানিয়ে নেয় ধর্মের মিলের কারণে।
নিজেদের এই আলাদা করে রাখার ফলে সাংস্কৃতিক আত্মীকরণ হয় না। এটা যেমন ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি সামাজিকতার ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুইটা সংস্কৃতির পার্থক্যকে স্বীকার করার প্রবণতা না থাকার কারণে, বা জাত্যাভিমানের কারণে আত্মীকরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পরের ধাপটা শুরু হয়- সাংস্কৃতিক ঘাত (cultural shock)। এই ধাপে জন্ম নেয় ভুল বুঝাবুঝি, ভয়, ঘৃণা আর শেষমেষ কারো রাজনৈতিক ফায়দা লুটার অস্ত্র হিসেবে সহিংসতা৷
এই জিনিস অভিবাসী আর অভিবাসিত দেশের লোক দুইয়ের মধ্যেই ঘটে। আপনি যত নিজেকে ওদের সংস্কৃতি থেকে আলাদা করবেন ততই আপনার ভিন্নতা ওদের চোখে প্রকট হতে থাকবে৷ আপনাকে ওদের সংস্কৃতির অংশ হতে হবে না, শুধু স্বীকার করুন সবারই নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। মেনে নিন ওদের সংস্কৃতি আপনার সংস্কৃতির মতই হাজার বছরের চলে আসা একটা প্রথা৷ আপনারটা আপনার কাছে সেরা, ওদেরটা ওদের কাছে। এতটুকু সহিষ্ণু হতে আপনার খুব বেশি একটা কষ্ট হওয়ার কথা না। ওদের সাথে বসে মদ-পর্ক খেতে হবে না, ওরা খায় এতটুকু স্বীকার করে নিন। দায় আপনার বেশি কারণ সেখানে আপনি গেছেন, তাদের সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে আপনাকে৷ কারণ ওদের দেশে ওদের সংস্কৃতি dominant।
সারা বিশ্বে যেভাবে রক্ষণশীল আর ডানপন্থীদের উগ্রতা বাড়ছে, এর মধ্যে ঘৃণা থেকে সহিংসতার জন্ম দিতে পারা লোক তাদের জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সাংস্কৃতিক ঘাতে থাকা লোকেদের ব্যবহার করবে৷ আর একমাত্র, শুধুমাত্র, কেবলমাত্র- সহিষ্ণুতাই পারবে ঘৃণার অন্ধকারে ভালবাসার আলো জ্বালাতে৷
এখানে একটা উদাহরণ দেই- ভারতের আম আদমি পার্টির সাবেক নেতা যোগেন্দ্র যাদব। দেশভাগের সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তাঁর দাদাকে বিক্ষুব্ধ মুসলিমরা হত্যা করে। পুরো ঘটনাটা যোগেন্দ্রর ৭ বছর বয়সী বাবা দেখেন৷ ৭ বছরের বাচ্চা নিজের পিতাকে হত্যা হতে দেখেছে, তার উপর কেমন প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে হয়?
যোগেন্দ্রর বাবার উপর যে প্রভাব পড়েছিল সেটা হচ্ছে তিনি সহমর্মি হয়েছিলেন। তাঁর একমাত্র ছেলের নাম রাখেন সেলিম। মানে যে মুসলিমদের হাতে তাঁর পিতা নিহত হন সে মুসলিমদের সংস্কৃতির নাম রাখেন নিজের ছেলের৷ পরে হাজার প্রশ্নের সামনে পড়া ছোট্ট সেলিম তাঁর বাবাকে অনুরোধ করেন নাম বদলে দিতে, সে থেকে সেলিম হয়ে যান যোগেন্দ্র। কিন্তু একটু ভাবুন, কতটুকু সহিষ্ণু হলে এমন কাজ করা যায়? আর নিজের ছেলেকে একই শিক্ষায় বড় করা যায়?
নিজের জীবনের জন্যে, নিজের সন্তানের জীবনের জন্যে, একটু চেষ্টা করুন পরের সংস্কৃতিকে মেনে নিতে৷ পার্থক্য থাকবে এটা স্বীকার করে নিন। আপনি নিজের দায়টা পালন করুন, অন্যরাও এগিয়ে আসবে৷ দেরিতে হলেও, আসবে। আপনার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যেন অন্যের মৃত্যুর কারণ না হয়।