সারা বিশ্ব সাড়া জাগানো পানামা পেপার্সের তথ্য অনুযায়ী আওয়ামীলীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ ও তার স্ত্রী নীলুফার জাফরুল্লাহও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের সাথে জড়িত। এই কেলেংকারীর সংবাদ প্রকাশিত হবার পর ও সেটি নিয়ে একটি ব্যাপক ভিত্তিক আলোচনা হবার পরেও সদ্য সমাপ্ত আওয়ামীলীগের কাউন্সিলে জনাব জাফরউল্লাহকে আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোনোনীত করে রাখা হয়েছে দেখে অনেকেই এই নিয়ে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন। ইতিমধ্যেই দুদক থেকে জনাব জাফরের বিরুদ্ধে চার্জশীট গঠন করা হয়েছে বলেও জানা গেছে এবং তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেই সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগনের কষ্টে অর্জিত অর্থ দূর্নীতির মাধ্যমে পাচার করবার পরেও বহাল তবিয়তেই রয়েছেন জনাব জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী নীলুফার জাফর। দুইজনেই বর্তমান সংসদের এম পি হিসেবে ক্ষমতার মধ্যমনি হিসেবেই রয়েছেন। লাজ নেই, লজ্জা নেই কিংবা এসবের কোনো সম্ভাবনাও তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। সবচাইতে আশ্চর্যের ঘটনা হচ্ছে এত ঘটনার পরেও বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী (অনির্বাচিত) শেখ হাসিনা এই অর্থ পাচারকারী জাফরকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে মোনোনীত করেছেন। একটি রাজনৈতিক দল কি এতটাই দেউলিয়া হয়ে গেছে যে একজন দূর্নীতিবাজ ও লুটেরাকে দলের এত বড় পদে মোনোনীত করতে হবে? ফরিদপুরে তিনি ছাড়াও আরো অনেকেই আছেন যারা খুব সহজেই এমন পদের দাবীদার কিন্তু তাদের উপেক্ষা করে এই রকম একজন ব্যাক্তিকে মনোনীত করবার কারনটাও আমাদের জানা নেই।
শুধু অর্থ কেলেংকারী-ই নয় বরং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করবার দায়েও এই কাজী জাফরুল্লাহর নাম সবার আগে উঠে আসে। ফরিদপুর থেকে বাচ্চু রাজাকার, কাদের মোল্লা ইত্যাদি ব্যাক্তিদের বিচারের কথা উঠলেও কখনোই আমরা দেখিনি এই কাজী জাফরুল্লাহর নামে আন্তর্জাতিক আদালতে কোনো অভিযোগ দায়ের হতে। এটি একদিকে যেমন তীব্র সন্দেহের আর অন্যদিকে কষ্টেরও।
এই ব্যাপারে ফরিদপুরের আরেক এম পি তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আখ্যা দিয়ে নিক্সন চৌধুরী বলেছেন,
“বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। কোনো যুদ্ধাপরাধীই বিচার থেকে রেহাই পাবে না। কাজী জাফরুল্লাহকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন নিক্সন চৌধুরী। তিনি বলেন, কাজী জাফরুল্লাহ দুর্নীতির রাজপুত্র। আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে তিনি দলের ক্ষতি করছেন। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘নৌকা প্রতীক’ বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিদেশে তার নামে কোটি কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তার দুর্নীতির বিষয়ে পানামা পেপার্স তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। এমপি নিক্সন চৌধুরী বলেন, শুধু কাজী জাফরুল্লাহ একাই দুর্নীতি করছেন না, তার স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি নিলুফার জাফরুল্লাহও এর মাধ্যমে টাকা কামাচ্ছেন। এসব দুর্নীতিবাজ পরিবারকে আর ভাঙ্গাবাসী দেখতে চায় না। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর-৪ আসনের সুযোগ নিয়ে কাজী পরিবার মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। আর এসব করতে দেয়া হবে না বলেও ঘোষণা দেন নিক্সন চৌধুরী”
উল্লেখ্য যে, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে ফাঁস হওয়া বিশ্বের নামীদামী রাষ্ট্রনায়ক, সরকার প্রধান ও প্রখ্যাত নেতাদের অর্থ পাচারের তালিকায় বাংলাদেশের ৩৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। এরা বিভিন্ন সময় দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছে বলে পানামা পেপার্সে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ২টি কোম্পানি, একজন সুবিধাভোগী ও ২২ জন শেয়ারহোল্ডার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ এবং তার স্ত্রী নিলুফার জাফর এমপি, সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানের বড় ভাই আজিজ খানসহ তার পরিবারের ৫ জনের নামও রয়েছে।
কাজী ‘পানামা পেপারস’ নামে ওসব নথি প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)। যদিও এরই মধ্যে ‘পানামা পেপারসে’ ফাঁস হওয়া দলিলের তথ্যের ফৌজদারি তদন্তে সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে পানামা সরকার। বাংলাদেশে এখনো এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না হলেও কর ফাঁকির গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার পর বিশ্বের ক্ষমতাধর রাজনীতিক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও অনেক সেলিব্রেটি এখন চাপের মুখে পড়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অর্থপাচারের ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। অফশোর ক্লায়েন্ট তালিকায় পানামার আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার ফাঁস হওয়া এই চাঞ্চচল্যকর গোপন নথিতে ২৫ বাংলাদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জড়িতের তথ্য ফাঁস হওয়ায় এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। তারা বিভিন্ন অফশোর কোম্পানির নামে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন বলে পানামা পেপারসে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে আইসিআইজের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত বৈশ্বিক অর্থপাচারের তালিকায় থাকা ২৫ বাংলাদেশী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার কথা জানানো হয়। আইরিশ টাইমসের ডিজিটাল প্রডাকশন বিষয়ক সম্পাদক ব্রায়ান কিলমার্টিনের তৈরি গ্রাফিকস ম্যাপে বাংলাদেশের ২২ শেয়ারহোল্ডার, ১ সুবিধাভোগী ও ২ কোম্পানির কথা জানানো হয়েছে। প্রথম দফায় তালিকা প্রকাশ করার পর আগামী মে মাসে দ্বিতীয় কিস্তি নথি প্রকাশের কথা রয়েছে। উইকিলিকসের টুইটার একাউন্টে প্রথম দফার ওই লিংকটি মঙ্গলবার শেয়ার করা হয়েছে। লিংকে বাংলাদেশের অনেকেই বিদেশে নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে বলে উঠে এসেছে। আইসিআইজের হস্তগত গোপন নথি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ী বিদেশে কোম্পানি স্থাপন করে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী নিলুফার জাফরের নাম।
বলা হয়েছে তারা বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে অফশোর কোম্পানির মালিক। জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী উভয়েই এ অভিযোগ নিয়ে একটি কথাও কোথাও বলেন নি এবং তাদের মৌনতাই কি সম্মতির লক্ষন বলে ধরে নেয়া হবে কিনা এটি নিয়েও সামাজিক মাধ্যমে চলছে নানাবিধ মুখরোচক গল্প। এছাড়া সামিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড মার্কেন্টাইল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আজিজ খান, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আজিজ খান, কন্যা আয়েশা আজিজ খান, ভাই জাফর উমায়েদ খান ও ভাগ্নে ফয়সাল করিম খানের বিদেশে মোট ছয়টি কোম্পানি চালান। এর মধ্যে জাফর উমেদ খান ও মো. ফয়সাল করিম খান বাদে তারা বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের কোম্পানি নিবন্ধন করিয়েছেন সিঙ্গাপুরের ঠিকানায়। এসব কোম্পানি অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত। তারা অফশোর কোম্পানির শেয়ারের মালিকানা নিতে নিজেদেরকে ডাইরেক্টর বা শেয়ারহোল্ডার দেখানোর চেয়ে নমিনি হিসেবে দেখিয়েছে।
তবে আজিজ খান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তাদের কার্যক্রম আইনসম্মত বলে দাবি করেন। ওই তালিকায় আরও নাম আছে অনেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর, যারা বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে অফশোর কোম্পানির মালিক। এর মধ্যে আছেন ইউনাইটেড গ্রুপের হাসান মাহমুদ রাজা, খন্দকার মইনুল আহসান (শামীম), আহমেদ ইসমাইল হোসেন ও আখতার মাহমুদ। এতে নাম আছে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজের সাবেক সভাপতি এ এমএম খানের। ওই তালিকায় নাম আছে মোমিন টি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজমল মইন, পাট ব্যবসায়ী দিলিপ কুমার মোদির। তারা দু’জনেই ২০০৫ সালের মার্চে রাইটস্টার প্রাইভেটের পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হন। সি পার্ল লাইন্সের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ সিরাজুল হকের নামও আছে এতে। বলা হয়েছে তিনি সভারিন ক্যাপিটল প্রাইভেটের ডাইরেক্টর বা শেয়ারহোল্পার। এটা নিবন্ধিত হয়েছে ২০১০ সালে। ওই তালিকায় নাম আছে বাংলা ট্রাক লিমিটেডের মো. আমিনুল হক, নাজিম আসাদুল হক ও তারিক একরামুল হকের। এ ছাড়া নাম আছে ওয়েস্টার্ন মেরিনের পরিচালক সোহেল হাসানের। নাম আছে মাসকট গ্রুপের চেয়ারম্যানএফএম জুবাইদুল হকের। বলা হয়েছে তিনি তার স্ত্রী সালমাসহ অফশোর কোম্পানি স্প্রিয় শো’র ইন্টারন্যাশনালের ডাইরেক্টর/শেয়ারহোল্ডার হন ২০০৭ সালের মে মাসে।
এ তালিকায় আরও নাম আছে সেতু করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাবুদ্দিন চৌধুরীর। স্ত্রী উম্মেহর সঙ্গে তিনি ২০০৭ সালের আগস্টে তালাভেরা ওয়ার্ল্ডওয়াইডের ডাইরেক্টর/শেয়ারহোল্ডার হন। স্কাপর্ক লিমিটেড এবং অমনিকেম লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখারুল আলমের নাম রয়েছে ওই তালিকায়। রয়েছে তার পুত্রবধূ ফওজিয়া নাজের নাম। বলা হয়েছে তারা সিটি লিঙ্কের মালিক। তারা ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে সিঙ্গাপুরের ঠিকানা ব্যবহার করে পাউমি টেকনোলজি লিমিটের ডাইরেক্টর/শেয়ারহোল্ডার হন। আবদুল মোনেম লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আএসএম মহিউদ্দিন আহমেদ, তার স্ত্রী আসমা মোনেমের নাম রয়েছে এতে। বলা হয়েছে তারা ২০০৮ সালের জুনে অফশোর কোম্পানি ম্যাগনিফিসেন্ট ম্যাগনিটিউডের ডাইরেক্টর/শেয়ারহোল্ডার হয়েছেন। এতে আরও নাম রয়েছে অনন্ত গ্রুপের শরিফ জাহিরের নাম। বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি সিপিএটি (সিঙ্গাপুর) প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালক হয়েছেন।
এত ঘটনার পর আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে এই দূর্নীতর বর পূত্র কাজী জাফরুল্লাহ কে কখন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে? কবে তার রাজাকারির বিচার হবে কিংবা কবেই বা তার অর্থ পাচারের বিচার এই বাংলার মাটিতে হবে?