আপনার বাড়ি আরেকজনকে দখল দিয়ে আপনাকে আরেকজনের বাড়ির উঠানে শরণার্থী হতে বাধ্য করলে আপনার কেমন লাগবে? লাঠি হাতে প্রতিরোধ করতে ইচ্ছে করবে না? পাহাড়ের সমস্যাটা আগে জানুন তারপর পাহাড়িদের সমালোচনা করুন। পাহাড়ে বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক তা তিনি চাকমা হোন আর বাঙালী- তিনি জমি কিনে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতে পারবেন। পাহাড়ে বাঙালীরা থাকতে পারবে না এমন কথা কোথাও বলা নেই। কোন পাহাড়ি তেমনটা ভাবেনও না। কিন্তু পাহাড়িদের গ্রামে ঢুকে বিজিবি, সেনাবাহিনী জোর করে ২০-২৫টা পাহাড়ি পরিবারকে উচ্ছেদ করে সেখানে বাঙালীদের থাকার ব্যবস্থা করাকে কি নাম দেয়া যাবে? ‘সেটলার বাঙালী’ বলতে পাহাড়ীদের কাছে যে ভীতিকর এক সম্প্রদায় স্বাধীনতার পর দানবের মত বেড়ে উঠেছে তার বৈধতা কোন সভ্য দুনিয়াতে পাওয়া যাবে না। কোন সভ্য জাতি এই জুলুম অত্যাচারকে বৈধ মনে করতে পারে না…।
বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়ান ২০১৪ সালে শশী মোহন কার্বারী পাড়া থেকে রাতের আঁধারে ২১টি পাহাড়ি পরিবারকে উচ্ছেদ করে সেই জায়গায় তাদের হেড কোয়াটার নির্মাণ করে। এরকম ঘটনা শত শত দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে জুম চাষ করে নিজেদের পেটের ভাত জোগাড় করে আদিবাসীরা। সেই জমি দখল করতে করতে সরকার তাদেরকে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছে। পর্যটন স্পট করার নামে শত শত পাহাড়ী পরিবারকে গরু ছাগলের মত উচ্ছেদ করেছে সরকার। এমন না যে সরকার জমির দরকার পড়েছিল তাই ন্যায্য মূল্য দিয়ে খরিদ করেছে। পাহাড়িদের এই রাষ্ট্রের ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ আর ‘মুসলমান জাতীয়তাবাদ’- এই লালু আর কালু দুই ভাইয়ের কেউই তাদেরকে দেশের নাগরিকই মনে করে না। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী চেতনা আর মুজিবের বাঙালী চেতনার মধ্যে ব্রাকেটে মুসলিম শব্দটি হাইড করা থাকে। এটা হারে হারে টের পায় কেবল বাঙালী হিন্দু আর পাহাড়ি সমতলী আদিবাসীরা। গোবিন্দগঞ্জের ঘা শুকাতে না শুকাতে রমেল চাকমাকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহৃ করে দেয়া হয়েছে। গত ৪৬ বছরের ইতিহাস এর চেয়ে নির্মম। কোন অংশে কম নয়।
খাকড়াছড়িতে এক সময় মাত্র ১ শতাংশ বাঙালী ছিল। এখন সংখ্যাটা ৮০ শতাংশ! অস্বাভাবিকভাবে এই বৃদ্ধিটা হয়েছে সেনা বাহিনীর জোরজবরদস্তি পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে বাঙালীদের পুশ করার মাধ্যমে। পাহাড়িদের ‘শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসী’ হিসেবে ভয়ংকর নিষ্ঠুর খুনে একটা জাতি হিসেবে আমাদের রাষ্ট্র পরিচিত করলেও পাহাড়ের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে মিথ্যা বাঙালী যুবককে অপহরণের অভিযোগ তুলে পাহাড়িদের বসতবাড়ি দোকানপাটে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া খুব নিয়মিত ঘটনা। মসজিদ থেকে ‘সন্ত্রাসী পাহাড়িদের’ প্রতিরোধ করতে ডাক দিয়ে পাহাড়ি গ্রামে আক্রমণটা সেটলার আওয়ামী বিএনপি মিলেমিশেই করে। ২০১৩ সালে তাইন্দংয়ে এরকমই একটি পরিকল্পিত হামলা চালিয়ে পাহাড়িদের বসতবাড়ি, দোকানপাটে আগুন জ্বালানো হয় কথিত কামাল হোসেন নামের এক সেটলার বাঙালীকে অপহরণের অভিযোগে যা ছিল সম্পূর্ণই মিথ্যা বানোয়াট। এইসব সেটলার বাঙালীরা পাহাড়ীদের চৌদ্দপুরুষের ভূমিকে দখল করে নিয়ে তাদেরকেই করছে সেই জমিতে পরবাসী। তার প্রতিবাদ করলেই পাহাড়িরা বিচ্ছিন্নতাবাদী! স্বাধীনতা সার্বভ্রৌমত্বের জন্য হুমকি!
নাসিরনগরের ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুরা মার খেয়ে নিরবে দেশ ত্যাগ করলে তারা কাপুরুষ, ভীতু দেশপ্রেমহীন ভারতীয় দালাল। আর মার খেয়ে পাহাড়ীরা লড়াই করলে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী!
একজন আশি বছরের বৃদ্ধ পাহাড়ীর জীবনটা এরকম: শৈশব-কৈশরে একাধিক সেনা উচ্ছেদের শিকার হয়ে নিজের দেশেই নিজের গ্রাম থেকে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেয়া নানা কেম্পে। যৌবন আসতে আসতে পাশের দেশ ভারতে আশ্রয়। মাঝ বয়েসে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ আর আশ্বাসে ফের দেশে ফেরা। তারপর আশি বছর বয়েসে আবার নতুন করে নিজ দেশে উদ্বাস্তু হওয়া। এর নাম পাহাড়ী জীবন। যে দেশটাতে সাত পুরুষের ভিটা, সেই দেশটাই তাদের রোজ একবার করে মনে করিয়ে দিচ্ছে, এটা তোদের দেশ না!…