হবিগঞ্জে দাজ্জালাএর মত আবির্ভূত হয়েছে এখানকার এম পি আবু জাহির। যার ছিলোনা কিছুই, এখন ফুলে আর ফেঁপে একাকার। সন্ত্রাসগোষ্ঠী লালন পালন থেকে শুরু করে চাঁদাবাজী সব কিছুতেই তার এখন একচ্ছত্র আধিপত্য।
এগারো বছর আগে থাকতেন ভাড়া বাসায়। এখন হবিগঞ্জ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশের সেই ভাড়া বাসার কাছে তার হয়েছে সাততলা বাড়ি। আছে হবিগঞ্জ স্টেডিয়ামের পাশে ৩০ কোটি টাকা মূল্যের ১০ বিঘা জমি। তেগুরিয়া পিডব্লিউডি অফিসের পাশে রয়েছে আরও একটি চারতলা ভবন।
হবিগঞ্জ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের জায়গা ও ধুলিয়া খালের পাশে নিরীহদের জমি দখল করেছেন। রাজধানী ঢাকাতেও রয়েছে তার প্লট-ফ্ল্যাট। মেয়ের বিয়েতে স্টেডিয়াম দখল করে হাজার হাজার মানুষের ভূরিভোজ করিয়েছেন। দামি বিলাসবহুল একাধিক গাড়িও রয়েছে। অথচ তার কোনো ব্যবসাও নেই। এ ছাড়া প্রবাসীর টাকা আত্মসাৎ, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা, বনাঞ্চল থেকে সিরামিকসের মাটি উত্তোলন করে বন ধ্বংস, নিয়োগ-বাণিজ্য- এ রকম অসংখ্য অভিযোগে জড়িয়ে রয়েছে তার নাম। তার রোষানল থেকে সাংবাদিকরাও রেহাই পাননি। মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন। করেছেন নানাভাবে হয়রানি। আর এসব করেছেন হবিগঞ্জ-৩ আসনের (হবিগঞ্জ সদর-লাখাই-শায়েস্তাগঞ্জ) সংসদ সদস্য আবু জাহির। তিনি হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। তার ভয়ে একজন প্রবাসী এলাকায় যেতে পারছেন না। আবু জাহিরের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনেও অভিযোগের পাহাড় জমা পড়েছে বলে জানা যায়। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংসদ সদস্য আবু জাহির। নিজেকে তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ উল্লেখ করে তিনি সমকালকে বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৭০ শতাংশ ভোট পেয়েছি। এরপর এ পর্যন্ত এমপি। তার দাবি, মানুষের জন্য ভালো কাজ না করলে কেউ তাকে বারবার এমপি নির্বাচিত করেননি।
হবিগঞ্জ ও লাখাইয়ের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অলিপুর এলাকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলেন আবু জাহির। এখান থেকে তার মাসিক আয় ২০ লাখ টাকা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী নিয়োগ দিয়ে জনপ্রতি তিন লাখ টাকা নিয়েছেন। লাখাই উপজেলার সব জলমহালে একসময় জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু ওই সব জলমহালে এখন জেলেদের জালা ফেলা নিষেধ। আবু জাহির তার নিজস্ব লোকজন দিয়ে সেখানে মাছ চাষ করেন। ওই সব জলমহাল থেকে প্রতিবছর তার আয় অন্তত ১০ কোটি টাকা। জেলেদের কেউ জাল ফেলতে গেলেই তাদের এমপির লোকজনের দ্বারা নির্যাতিত হতে হয়। কিছুদিন আগে লাখাই-হবিগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজের জন্য ১৪৭ কোটি টাকার টেন্ডার হয়। কাজ পাওয়া ঠিকাদারের কাছ থেকে তিনি ১৩ কোটি টাকা আগেই নিয়েছেন। দীর্ঘদিনেও ওই কাজের কোনো অগ্রগতি নেই।
এ নিয়ে ঠিকাদারকে এলাকাবাসী কিছু বললেই এমপির লোকজন তাদের ওপর চড়াও হয়। লাখাই-হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জ এলাকায় কোনো উন্নয়নকাজ হলেই সেই কাজ পেতে আবু জাহিরকে কমিশন দিতে হয়। হবিগঞ্জ শহরের বড় ব্যবসায়ীদের নিয়মিত চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। চাঁদা না দিলে বিভিন্নভাবে তাদের হয়রানি ও ব্যবসার ক্ষতিসাধন করা হয়। দলীয় নেতাকর্মী তার মতের বিরুদ্ধে গেলেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। স্থানীয় সাংবাদিক শোয়েব চৌধুরী তার অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়। ওই মামলায় জেল খাটেন শোয়েব চৌধুরী। এ ছাড়া হাফিজুর রহমান নিয়ন নামে স্থানীয় আরেক সাংবাদিককেও মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন এমপি জাহির। তার অপকর্মের প্রতিবাদকারীদের শায়েস্তা করতে দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে মামলা করেন। হবিগঞ্জ শহরে তার এখন একাধিক বহুতল বাড়ি। ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর থেকেই রাতারাতি এসব বাড়ির মালিক হয়েছেন। একেকটি বাড়ির দাম পাঁচ-ছয় কোটি টাকা।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের যত ঠিকাদারি কাজ হয়, সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি জাহির। বেনামে নিজেই ঠিকাদারি করেন। নামমাত্র কাজ করেই বিল তুলে নেন। লাখাই উপজেলায় জাপানি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান জাইকা ও ফিলিপের নেওয়া প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ করে উচ্চদরের বিল আদায় করা হয়েছে। এমপি হওয়ার পর থেকেই আবু জাহিরের বিত্তবৈভব বাড়তে থাকে। হবিগঞ্জ-ঢাকা ছাড়াও বিদেশেও তার বাড়ি-ফ্ল্যাট হয়েছে। বর্তমানে লন্ডনপ্রবাসী তার মেয়ের বিয়েতে তিনি কয়েক কোটি টাকা খরচ করেন। হবিগঞ্জ স্টেডিয়ামে ৪০ হাজার মানুষকে দাওয়াত দিয়ে রাজকীয় খানাদানার আয়োজন করেন। বিভিন্ন উপজেলা, ইউপি চেয়ারম্যান, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুরো খরচের টাকা আদায় করেন। এ ছাড়া এমপি হওয়ার পর রেলওয়ে বাইপাস সড়কের ঈদগার পাশে এক কানাডাপ্রবাসীর ৩০ শতাংশ জমি দখল করেন। ওই জমির মূল্য অন্তত ১০ কোটি টাকা। তেগুরিয়া পিডব্লিউডি অফিসের পাশে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আরেকজনের ৩০ শতাংশ জমি দখল করেছেন। ওই জমির মূল্য প্রায় ছয় কোটি টাকা। এ ছাড়া বাল্লা স্থলবন্দরের পাশে সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে জানতে পেরে তিনি ওই এলাকায় ২০০ শতাংশ জমি কেনেন। পরে অধিগ্রহণ করলে সরকারের কাছ থেকে বাজারমূল্যের চার গুণ ক্ষতিপূরণ বাবদ আদায় করেন। হবিগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যেসব লেনদেন হয়, সেই টাকারও একটি অংশ পান আবু জাহির। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের তাজুল গংয়ের তাজুলের কাছ থেকে প্রতি মাসে সেই টাকা তিনি বুঝে নেন। পুটিঝুড়ি ফরেস্ট এলাকা থেকে সিরামিকের জন্য সিলিকা বালু অবৈধভাবে উত্তোলন করে বনের ধ্বংস করা হচ্ছে। ওই সিলিকা বালু উত্তোলনের কাজও করে এমপির লোকজন। ওখান থেকেও একটি বড় অঙ্কের আয় হয় তার। এ ছাড়া ধুলিয়া খালের পশ্চিমে তার ভাই বদরুল আলমকে দিয়ে নিরীহ মানুষের জমি, অলিপুর সিটি পার্কের পাশের নিরীহদের জমি দখলের অভিযোগ আছে অভিযোগপত্রে। হবিগঞ্জ আধুনিক হাসপাতালের সব কিছু ক্রয় ও সরবরাহের দায়িত্ব পালন করেন মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজের হাজী মোকলেছ। মোকলেছের নামে বাস্তবে এমপিই এসবের নিয়ন্ত্রক। বর্তমানে এমপির দুটি নতুন মডেলের পাজেরো ও একটি টয়োটা প্রিমিয়ার গাড়ি রয়েছে।
হবিগঞ্জের একজন বাসিন্দা জানান, আগে হবিগঞ্জ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন এমপি। পরে তার স্ত্রী আলেয়া জাহিরকে সভাপতি বানান। স্কুলের সামনে কিছু দোকান রয়েছে। সেগুলোর ভাড়া আদায় করেন এমপির ভাই বদরুল আলম। স্কুল ও কলেজের যে কোয়ার্টার রয়েছে, তাও দখলে নিয়ে বসবাস করেন বদরুল আলম।
প্রবাসীর টাকা আত্মসাৎ: হবিগঞ্জের ফায়ার সার্ভিস রোডের বাসিন্দা লন্ডন প্রবাসী গাজীউর রহমান সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, তিনি ও তার ভাই সাইদুর রহমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কদমতলী এলাকায় একটি সিএনজি পাম্প স্থাপনের জন্য জমি কেনেন। গাজীউর রহমানের লন্ডনপ্রবাসী বন্ধু কালাম ও শামসুলও ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে থাকতে আগ্রহী হন। তাদের যুক্ত করে সিএনজি পাম্পের ব্যবসা চলতে থাকে। কিন্তু এক রাতে কে বা কারা পাম্পে ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় কালাম ও শামসুল তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা অভিযোগ করেন। বিষয়টি এমপির কাছেও যায়। এমপির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয় কালাম ও শামসুলের পুঁজিসহ লাভ বুঝিয়ে দিলে পুরো পাম্পের মালিকানা গাজীউর ও তার ভাই সাইদুরকে দিয়ে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে করা মিথ্যা অভিযোগ তুলে নেওয়া হবে। পরে গাজীউর ৫৫ লাখ টাকার চেক এমপি আবু জাহিরকে দিয়ে দেন। কিন্তু আবু জাহির চেকগুলো কালাম ও শামসুলের নামে না নিয়ে তার পিএস, ছেলে, মেয়ে ও ভাইয়ের নামে নেন এবং এগুলো ক্যাশ করিয়ে নেন। এরপর এমপি আবু জাহির আরও ৭০ লাখ টাকার চেক দাবি করেন। না দিলে গাজীউর রহমানকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। এ অবস্থায় আবারও গাজীউর এমপির পিএস, ছেলে, মেয়ে ও ভাইয়ের নামে প্রায় ৭০ লাখ টাকার চেক দিতে বাধ্য হন। কিন্তু গাজীউরের অ্যাকাউন্টে ওই পরিমাণ টাকা না থাকায় চেকগুলো ক্যাশ করা যায়নি। তিনি চেকগুলো ব্যাংক থেকে ডিজঅনার করান। এরপর থেকেই এমপি তার পরিবারের সদস্যদের দিয়ে গাজীউরের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ আদালতে পৃথক তিনটি মামলা করান। এ ছাড়া বিভিন্ন মোবাইল নম্বর থেকে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া শুরু হয়। এ ঘটনায় গাজীউর রহমান গত ৮ নভেম্বর হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি জিডি করেন। এরপর এমপির ভয়ে গাজীউর রহমান আর এলাকায় যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। এদিকে এমপির প্রভাবে সেই জিডিরও কোনো তদন্ত করেনি পুলিশ প্রশাসন।